ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (Diabetic Retinopathy)
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কী?
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হলো ডায়াবেটিসের কারণে রেটিনার রক্তনালীগুলোর ক্ষতি হওয়া, যা ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে এবং অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। এটি টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস থাকা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা হিসেবে দেখা যায়।
ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত থাকলে রেটিনার ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, রক্ত ও তরল লিক হতে শুরু করে এবং নতুন অস্বাভাবিক রক্তনালী তৈরি হয়, যা দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি করতে পারে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির লক্ষণ ও উপসর্গ (Signs & Symptoms of Diabetic Retinopathy)
প্রাথমিক পর্যায়ে (Early Stage)
✅ সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না।
✅ কখনো কখনো হালকা ঝাপসা দৃষ্টি (Blurred Vision) হতে পারে।
✅ রাতে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া (Night Vision Impairment)।
উন্নত পর্যায়ে (Advanced Stage)
✅ চোখের সামনে ফ্লোটার বা ছোট ছোট কালো বিন্দু দেখা (Floaters in Vision)।
✅ আলো সহ্য করতে না পারা (Photophobia)।
✅ পরিপ্রেক্ষিত দৃষ্টি কমে যাওয়া (Loss of Peripheral Vision)।
✅ চোখের সামনে পর্দার মতো কিছু দেখা (Curtain-like Shadow Over Vision)।
✅ গভীর পর্যায়ে সম্পূর্ণ অন্ধত্ব (Complete Vision Loss)।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ধাপসমূহ (Stages of Diabetic Retinopathy)
১. নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (NPDR - Non-Proliferative Diabetic Retinopathy)
✅ রেটিনার ক্ষুদ্র রক্তনালী ফেটে যাওয়া (Microaneurysms)।
✅ রক্তক্ষরণ ও এক্সুডেট (Retinal Hemorrhages & Exudates)।
✅ কটন-উল স্পট (Cotton Wool Spots)।
✅ রেটিনার মধ্যে তরল জমে যাওয়া (Diabetic Macular Edema - DME)।
২. প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (PDR - Proliferative Diabetic Retinopathy)
✅ নতুন, দুর্বল রক্তনালী তৈরি হয় (Neovascularization)।
✅ অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ (Vitreous Hemorrhage)।
✅ রেটিনাল ডিটাচমেন্ট (Retinal Detachment)।
✅ অপটিক নার্ভের ক্ষতি ও অন্ধত্ব (Optic Nerve Damage & Blindness)।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা (Investigations for Diabetic Retinopathy)
১. ফান্ডোস্কপি বা অপথালমোস্কপি (Fundoscopy or Ophthalmoscopy)
✅ চক্ষু বিশেষজ্ঞ সরাসরি রেটিনার রক্তনালীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
২. অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (OCT - Optical Coherence Tomography)
✅ রেটিনার স্তরের মধ্যে তরল জমার পরিমাণ বিশ্লেষণ করা যায়।
৩. ফ্লুরোসিন অ্যানজিওগ্রাফি (Fluorescein Angiography - FA)
✅ রেটিনার রক্তনালীতে লিকেজ বা ব্লকেজ আছে কিনা তা শনাক্ত করা হয়।
৪. বি-স্ক্যান আল্ট্রাসোনোগ্রাফি (B-Scan Ultrasonography)
✅ রেটিনাল ডিটাচমেন্ট বা ভিট্রিয়াস রক্তক্ষরণ থাকলে এটি শনাক্ত করা যায়।
৫. রক্ত পরীক্ষা (Blood Tests)
✅ হিমোগ্লোবিন A1c (HbA1c) – ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ কেমন তা নির্ধারণ করা হয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসা (Treatment of Diabetic Retinopathy)
১. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ (Control Blood Sugar Level) – সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
✅ HbA1c ৭% এর নিচে রাখা উচিত।
✅ নিয়মিত ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
২. এন্টি-ভিজিএফ ইনজেকশন (Anti-VEGF Injections) – রক্তনালীর লিকেজ থাকলে
✅ যেমন অ্যাভাস্টিন (Avastin), রেনিবিজুম্যাব (Ranibizumab) বা অ্যাইলিয়া (Aflibercept)।
3. লেজার থেরাপি (Laser Photocoagulation) – গুরুতর NPDR বা PDR-এর জন্য
✅ রেটিনার অস্বাভাবিক রক্তনালী বন্ধ করতে লেজার ব্যবহার করা হয়।
✅ ডায়াবেটিক ম্যাকুলার এডেমার জন্যও কার্যকর।
৪. ভিট্রেক্টমি সার্জারি (Vitrectomy Surgery) – গুরুতর রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে
✅ যদি ভিট্রিয়াসে রক্তক্ষরণ বা রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়, তাহলে এই অস্ত্রোপচার করা হয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধ (Prevention of Diabetic Retinopathy)
✅ ১. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন (Maintain Blood Sugar Level)
নিয়মিত HbA1c পরীক্ষা করুন।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিন নিন।
✅ ২. উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করুন (Control Blood Pressure & Cholesterol)
লো-সল্ট ও লো-ফ্যাট ডায়েট অনুসরণ করুন।
✅ ৩. নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করুন (Routine Eye Check-up)
ডায়াবেটিস রোগীদের বছরে অন্তত ১-২ বার চোখ পরীক্ষা করা উচিত।
✅ ৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন (Avoid Smoking & Alcohol)
এটি রক্তনালীর ক্ষতি রোধ করতে সাহায্য করে।
✅ ৫. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন (Maintain a Healthy Diet)
সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম ও মাছ খান।
✅ ৬. নিয়মিত ব্যায়াম করুন (Exercise Regularly)
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন।
সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
✔ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হলো ডায়াবেটিসের কারণে রেটিনার রক্তনালীগুলোর ক্ষতি হওয়া।
✔ দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস দৃষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
✔ প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ নাও থাকতে পারে, তাই নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা জরুরি।
✔ রক্তে শর্করা, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা এর প্রতিরোধে সহায়ক।