রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা (Retinitis Pigmentosa - RP)
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা (RP) কী?
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা (Retinitis Pigmentosa - RP) হলো একটি বংশগত বা জিনগত রোগ, যেখানে রেটিনার ফটো-রিসেপ্টর কোষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এটি প্রধানত রড (Rod) ও কোন (Cone) কোষকে আক্রান্ত করে, যার ফলে রাতকানা (Night Blindness), দৃষ্টিক্ষেত্র সংকীর্ণ হওয়া (Tunnel Vision) এবং অন্ধত্বের দিকে অগ্রসর হওয়া দেখা যায়।
এই রোগটি ক্রমশ অগ্রসরমান (Progressive Disease) এবং বর্তমানে এর কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার ধরন (Types of RP)
১. ক্লাসিকাল বা সাধারণ RP (Typical RP)
✅ ধীরে ধীরে রড ও কোন কোষ নষ্ট হয়ে যায়।
✅ রাতকানা (Nyctalopia) প্রথম লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।
✅ টানেল ভিশন (Tunnel Vision) ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
২. এটিপিক্যাল RP (Atypical RP)
✅ ইউশার সিনড্রোম (Usher Syndrome): RP + শ্রবণ শক্তি হ্রাস।
✅ RP sine pigmento: পিগমেন্ট জমে না, তবে দৃষ্টিশক্তি কমে।
✅ পারিভানসুয়াল RP: চোখের নির্দিষ্ট অংশে ক্ষতি হয়।
✅ সেন্ট্রাল RP: কেন্দ্রীয় দৃষ্টি দ্রুত নষ্ট হয়।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার কারণ (Causes of RP)
এই রোগটি প্রধানত জিনগত (Genetic) বা বংশগত। বিভিন্ন জিনগত মিউটেশন (Gene Mutation) RP ঘটাতে পারে।
বংশগত ধরণ (Modes of Inheritance)
✅ অটোসোমাল ডমিনেন্ট (Autosomal Dominant - AD):
২০-৩০% ক্ষেত্রে হয়।
ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় এবং তুলনামূলক ভালো প্রোগনোসিস থাকে।
✅ অটোসোমাল রিসেসিভ (Autosomal Recessive - AR):
৫০-৬০% ক্ষেত্রে হয়।
মধ্য বয়সে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
✅ এক্স-লিংকড (X-Linked - XL):
৫-১৫% ক্ষেত্রে হয়।
সাধারণত ছেলেরা আক্রান্ত হয়, মেয়েরা বাহক (Carrier) থাকে।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার রোগগত প্রক্রিয়া (Pathogenesis of RP)
✅ রড কোষ প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে রাতকানা (Nyctalopia) ও পার্শ্বীয় দৃষ্টি কমে যায়।
✅ পরবর্তীতে কোন কোষ নষ্ট হয়, যার ফলে রঙের দৃষ্টি ও কেন্দ্রীয় দৃষ্টি হারিয়ে যায়।
✅ রেটিনায় পিগমেন্ট জমে (Bone Spicule Pigmentation) এবং রেটিনা সরু হয়ে যায়।
✅ অপটিক এট্রোফি (Optic Atrophy) ও ম্যাকুলার ক্ষতি হতে পারে।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার ক্লিনিক্যাল লক্ষণ ও উপসর্গ (Clinical Features of RP)
প্রাথমিক লক্ষণ (Early Symptoms)
✅ রাতকানা (Night Blindness - Nyctalopia) প্রথম ও প্রধান লক্ষণ।
✅ কম আলোতে বা অন্ধকারে চলাফেরায় সমস্যা হয়।
✅ পার্শ্বীয় দৃষ্টি কমে যাওয়া (Peripheral Vision Loss)।
উন্নত পর্যায়ের লক্ষণ (Advanced Symptoms)
✅ টানেল ভিশন (Tunnel Vision) – চারপাশের দৃষ্টি হারিয়ে যায়।
✅ বস্তুর গঠন বিকৃত দেখা (Metamorphopsia)।
✅ রঙ চেনার ক্ষমতা কমে যাওয়া (Dyschromatopsia)।
✅ ফোটোফোবিয়া (Photophobia) – অতিরিক্ত আলোতে চোখে কষ্ট।
✅ অন্ধত্ব (Complete Blindness) – রোগের শেষ পর্যায়ে পুরো দৃষ্টি হারিয়ে যেতে পারে।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার নির্ণয় পদ্ধতি (Investigation of RP)
১. চক্ষু পরীক্ষা (Ophthalmological Examination)
✅ ফান্ডোসকপি (Fundoscopy):
বোন স্পিকুল পিগমেন্টেশন (Bone Spicule Pigmentation) দেখা যায়।
অপটিক এট্রোফি ও সরু রক্তনালী থাকে।
✅ ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট (Visual Field Test):
টানেল ভিশন কতটা অগ্রসর হয়েছে তা নির্ণয় করা হয়।
২. বিশেষ পরীক্ষা (Special Tests)
✅ ইলেক্ট্রোরেটিনোগ্রাফি (ERG):
রড ও কোন কোষের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়।
RP থাকলে ERG সিগন্যাল কমে যায় বা অনুপস্থিত থাকে।
✅ অপটিকাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (OCT):
রেটিনার গঠন বিশ্লেষণ করা হয়।
ম্যাকুলার এডিমা বা কোন কোষের ক্ষতি শনাক্ত করা যায়।
✅ জেনেটিক টেস্টিং (Genetic Testing):
রোগের ধরণ ও বংশগত সংযোগ নির্ণয় করা হয়।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার চিকিৎসা (Treatment of RP)
বর্তমানে RP-এর নিরাময় নেই, তবে কিছু থেরাপি রয়েছে যা রোগের অগ্রগতি ধীর করতে পারে।
১. ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থেরাপি
✅ ভিটামিন A (15,000 IU/দিন) – কিছু ক্ষেত্রে RP-এর অগ্রগতি ধীর করতে পারে।
✅ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড – রেটিনার কোষ সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে।
২. কার্বোনিক অ্যানহাইড্রেজ ইনহিবিটর (CAI) – যেমন Acetazolamide
✅ ম্যাকুলার এডিমা থাকলে এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
৩. জিন থেরাপি (Gene Therapy) – ভবিষ্যৎ চিকিৎসা
✅ RPE65 জিন মিউটেশনযুক্ত রোগীদের জন্য Luxturna (voretigene neparvovec) নামক জিন থেরাপি যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত হয়েছে।
৪. স্টেম সেল থেরাপি (Stem Cell Therapy) –
✅ রেটিনার নতুন কোষ গজিয়ে তুলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
৫. বায়োনিক আই (Bionic Eye) –
✅ "Argus II Retinal Prosthesis System" – যান্ত্রিক রেটিনাল ইমপ্লান্ট যা কিছু দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে।
৬. লো ভিশন এইডস (Low Vision Aids)
✅ ম্যাগনিফাইং গ্লাস, ডিজিটাল অ্যাসিস্টিভ ডিভাইস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার প্রতিরোধের উপায় (Prevention of RP)
✅ RP বংশগত রোগ, তাই সরাসরি প্রতিরোধ করা যায় না।
✅ পরিবারে ইতিহাস থাকলে জেনেটিক কাউন্সেলিং করা উচিত।
✅ ভিটামিন A ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস RP-এর অগ্রগতি ধীর করতে সাহায্য করতে পারে।
✅ রোদ থেকে চোখ রক্ষায় UV প্রটেকটিভ সানগ্লাস ব্যবহার করা উচিত।
✅ নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করানো দরকার।
শেষ কথা
রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা একটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা চক্ষু রোগ, যার কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে বিভিন্ন থেরাপি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগের অগ্রগতি ধীর করা সম্ভব। আগামী দিনে জিন থেরাপি ও স্টেম সেল থেরাপি RP রোগীদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠতে পারে।